বাজেটের আকার কমানোর পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলইরানের তেল রফতানিতে বাধা নেইদশ পণ্যে রাজস্ব আহরণে ধসআমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের শুল্ককর যৌক্তিক হতে হবেমেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চায় আইপিডি
No icon

ব্যক্তি করদাতার রিটার্নে ‘গাড়ি’ আতঙ্ক

আপনি একজন নিয়মিত করদাতা। আপনার নামে হয়তো একটি গাড়ি রয়েছে, যা বিআরটিএ তে ই-টিআইএন দিয়ে নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু হঠাৎ কর অফিস থেকে আপনার কাছে নোটিশ এলো, আপনার নামে ১৮টি বা ১০৩টি গাড়ি রয়েছে। তখন কেমন লাগবে? আপনি যদি এই গাড়ির সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পারেন, তাহলে গাড়ি কেনার টাকার ওপর আপনাকে কর দিতে হবে। অর্থাৎ গাড়ি কেনার টাকা আপনার আয় হিসেবে গণ্য করে কর অফিস আপনাকে ট্যাক্স করে দেবে। সঙ্গে এসব গাড়ির ওপর প্রতিবছর কর দিতে হবে। এটা গল্প নয়, সত্যি। ই-টিআইএন অনুযায়ী, এমন বহু গাড়ির সন্ধান পেয়েছে বিভিন্ন কর অফিস। বিআরটিএ এর ডেটাবেজ যাচাই করে এমন তথ্য পেয়েছে।

করদাতা হয়তো জানেই না, তার ই-টিআইএন দিয়ে শত শত গাড়ি নিবন্ধন হয়েছে। মজার বিষয় হলো, এক ই-টিআইএন দিয়ে নিবন্ধন নেয়া এসব গাড়ির মালিক কখনও অন্য ব্যক্তি, কখনও কোনো প্রতিষ্ঠান। বহু করদাতাকে কর অফিস চিঠি দেয়ার পর তিনি জানতে পেয়েছেন যে, তার ই-টিআইএন দিয়ে বহু গাড়ি নিবন্ধন হয়েছে। এই নিয়ে কর অফিস, বিআরটিএ তে ধরনা দিয়েছেন বহু করদাতা। করদাতার ফাইলে গাড়ি এখন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর অফিস বলছে, গাড়ির সন্ধান পাওয়ার পর করদাতাকে জানানো হয়। তবে বিআরটিএ নিবন্ধন দেয়ার সময় ভালো করে দেখলে কোনো করদাতা হয়রানির শিকার হবে না।

এনবিআর সূত্রমতে, রাজধানীর শরিফ উদ্দিন (নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম) একজন মুদি ব্যবসায়ী। কয়েক বছর আগে ই-টিআইএন নিয়ে নিয়মিত রিটার্ন দিয়ে আসছেন। দুই বছর আগে কর অফিস থেকে তাকে নোটিশ করা হলো। তাকে বলা হয়েছে, তার নামে ৪৮টি গাড়ি রয়েছে, যার কর দিতে হবে। তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কারণ তার নিজের একটি গাড়িও নেই। অথচ কর অফিস বলছে, ওই গাড়িগুলোর মালিক তিনি। তার ই-টিআইএন দিয়ে গাড়িগুলোর নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। এই করদাতা বলছেন, আমার একটি গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই। অথচ আমার ফাইলে ৪৮টি গাড়ির কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি আমি কর অফিসকে জানিয়েছি। আর কর অফিস বলছে, তারা বিআরটিএ এর ডেটাবেইজ থেকে এই ব্যবসায়ীর ই-টিআইএন দিয়ে ৪৮টি গাড়ি নিবন্ধনের তথ্য পেয়েছে। দালাল আর বিআরটিএ এর চক্র টাকার বিনিময়ে এই করদাতার ই-টিআইএন ব্যবহার করে গাড়ির নিবন্ধন করেছেন।

এনবিআর সূত্রমতে, কর অঞ্চল-১০-এর আওতাধীন একটি সার্কেলের নিয়মিত করদাতা চিকিৎসক হুমায়ুন (ছদ্মনাম)। তার নিজের একটি গাড়ি রয়েছে। নিজের ই-টিআইএন দিয়েই এই গাড়ি নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর কর অফিস থেকে তাকে চিঠি দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, এই করদাতার ই-টিআইএন বিআরটিএর ডাটাবেজ থেকে যাচাইয়ে দেখা গেছে, তার নামে ১৪টি গাড়ি রয়েছে। অথাৎ তার ই-টিআইএন দিয়ে ১৪টি গাড়ি নিবন্ধন হয়েছে। গাড়িগুলোর কেনার টাকার উৎস ও কর পরিশোধের বিষয়ে কর অফিস তার কাছে জানতে চেয়েছে। তিনি হতবাক। সঠিক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে তাকে এই গাড়ি কেনার টাকা ও গাড়ির ওপর কর দিতে হবে। কর অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ১৪টি নয়, ১৮টি গাড়ি নিবন্ধন হয়েছে। কে বা কারা এই নিবন্ধন করেছেন, তিনি জানেন না। বিআরটিএ-কর অফিসে যোগাযোগ করেও কোনো সুরাহা পাননি তিনি। পরে কর অফিসের পরামর্শে তিনি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সঙ্গে বিষয়টি জানিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন, যাতে তিনি উল্লেখ করেন, আমার ই-টিআইএন দিয়ে নিবন্ধন নেয়া ১৪টি গাড়ি সম্পর্কে আমি অবগত নয়। এসব গাড়ির মালিক বা ঠিকানা সম্পর্কেও আমি জানি না। কর অফিসে পরে যোগাযোগ করে জানতে পারি আমার ই-টিআইএন দিয়ে মোট ১৮টি গাড়ি নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। গাড়ি নিয়ে আমি কর-সংক্রান্ত জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছি। তিনি আশঙ্কা করে বলেন, ভবিষ্যতে আমার এই তথ্য ব্যবহারের কারণে আমি বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে পারি। এসব গাড়ি সারাদেশের বিভিন্ন সার্কেলে নিবন্ধন করা হয়েছে। কিছু গাড়ির নিবন্ধনের তারিখ আমার ই-টিআইএন নিবন্ধন নেয়ার বেশ কয়েক বছর আগের।

এই করদাতার ই-টিআইএন দিয়ে যে ১৮টি গাড়ি নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এই করদাতার ই-টিআইএন দিয়ে মো. তাজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির নামে ১৯৯৬ সালে টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়ি নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। এছাড়া ২০০২ সালে মীর হোসেন মজুমদারের টয়োটা, একই বছর মো. দেলোয়ার হোসেন খোকনের টাটা, ২০০৩ সালে মো. কামরুল হাসানের টয়োটা, ২০০৭ সালে মো. মাহবুবুর রহমানের নামে টয়োটা, একই বছর সান্ডা রিতা অধিকারীর নামের টয়োটা, ২০০৯ সালে মো. খুরশিদ আলমের নামে টয়োটা, ২০১০ সালে মো. রফিকুল মজুমদারের নামে টয়োটা, ২০১৬ সালে একটি টয়োটা ও ২০১৮ সালে মো. নজরুল ইসলামের নামে একটি টয়োটা গাড়ি নিবন্ধন হয়। ২০১১ সালে এনার্জি প্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড, ২০১৩ সালে আইএফআইসি ব্যাংক, ২০১৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংক, ২০১৫ সালে জনতা ব্যাংক, ২০১৮ সালে নিটল মটরস এবং ২০১৯ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নামে গাড়ি নিবন্ধন হয়।

অপরদিকে রশীদ নামে একজন করদাতার নামে বিআরটিএর ডেটাবেজে ১৮টি গাড়ি পাওয়া গেছে। ওই করদাতার নামে একটি গাড়ি রয়েছে। বাকি গাড়িগুলো ওই করদাতার ই-টিআইএন দিয়ে নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। ই-টিআইএন একজনের নিবন্ধন আরেক জনের নামে কীভাবে বিআরটিএ নিবন্ধন দেয় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সূত্রমতে, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল হাই একজন নিয়মিত করদাতা। বর্তমানে তার বয়স ৬৪-৬৫ বছর। প্রবীণ এই আইনজীবীর নামে একসময় দুটি গাড়ি ছিল। এর মধ্যে গত পাঁচ-ছয় বছর আগে তিনি একটি গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। মালিকানা হস্তান্তরের সময় বিআরটিএ থেকে ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য তার কাছে ম্যাসেজ আসেনি। ফলে গাড়ি বিক্রি করলেও মালিকানা পরিবর্তন হয়নি। বিআরটিএর ডেটাবেইজে টিআইএন ও গাড়ি থাকায় কর অফিস দুটি গাড়ির ওপর ট্যাক্স করে দিয়েছে। ফলে এই আইনজীবীকে প্রতিবছর তাকে বাড়তি সাড়ে ১২ হাজার টাকা কর দিতে হচ্ছে। একই অভিযোগ ফরহাদ হোসেন নামে একজন করদাতার। তিনি একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার নামে দুটি গাড়ি ছিল। দুই বছর আগে তিনি একটি গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু মালিকানা পরিবর্তনের সময় তার কাছে কোনো মেসেজ আসেনি। ফলে তার নামে বিআরটিএ ডেটাবেইজে দুটি গাড়ি দেখাচ্ছে, যার ফলে ফেঁসে গেছেন তিনি। কর অফিস বিআরটিএ ডাটাবেইজ থেকে টিআইএন দেখে তার ফাইলে দুটি গাড়ির ট্যাক্স করে দিয়েছেন। ফলে একটি গাড়ি থাকলেও তাকে প্রতিবছর দুটি গাড়ি বাবদ ১২ হাজার টাকা কর দিতে হচ্ছে। এক টিআইএন দিয়ে ১০৩ গাড়ি নিবন্ধন

এনবিআর সূত্রমতে, চট্টগ্রামে তানিয়া জেসমিন নামে একজন করদাতার ই-টিআইএন দিয়ে ১০৩টি গাড়ি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রেশন নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বিআরটিএতে এমন ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এসব গাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএর আঞ্চলিক কার্যালয়কে চিঠি দিয়েছে কর অঞ্চল, চট্টগ্রাম। ওই করদাতার তথ্য বিআরটিএ থেকে যাচাই করার পর করদাতাকে জানানো হয়। পরে করদাতা কর অফিসকে জানায়, তার ই-টিআইএন দিয়ে মাত্র একটি গাড়ি নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। বাকি গাড়িগুলো কোনো চক্র তার ই-টিআইএন ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নিবন্ধন নিয়েছে।

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে কয়েক দিন ধরে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের মোবাইল ফোনে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদেবার্তা দেয়া হলেও জবাব দেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, বিআরটিএ চেষ্টা করে একটি গাড়ি নিবন্ধনের সময় সব কাগজ নেয়ার। সেক্ষেত্রে ই-টিআইএনও নেয়া হয়। তবে ই-টিআইএন যার নামে, তার নামে গাড়ি নিবন্ধন করা হয়। যদি একজনের ই-টিআইএন দিয়ে অন্যজনের গাড়ি নিবন্ধন হয়ে যায়, কেউ অভিযোগ করলে বিআরটিএ খতিয়ে দেখে।

এনবিআরের আয়কর বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেক করদাতার গাড়ি থাকলেও রিটার্নে দেখায় না। গাড়ি মালিকদের করের আওতায় আনতে আমরা বিআরটিএর ডেটাবেইজ ব্যবহার করছি। এতে সুফলও পাওয়া গেছে। অনেক করদাতার ফাইলে গাড়ি নেই, আমরা বিআরটিএ ডেটাবেইজ যাচাই করে গাড়ি শনাক্ত করেছি। কর আদায় করেছি। আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি যে, এক টিআইএন দিয়ে অনেক গাড়ি নিবন্ধন হয়েছে। করদাতার নামে হয়তো একটি গাড়ি রয়েছে। বাকি গাড়ি নিবন্ধন ওই টিআইএন দিয়ে হয়েছে। অনেক সার্কেলে এমন অভিযোগ করেছেন করদাতারা। কর অঞ্চল থেকে বা করদাতা নিজে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। তিনি বলেন, কোনো দালাল চক্র টাকার বিনিময়ে করদাতাদের টিআইএন ব্যবহার করে নিবন্ধন করিয়েছেন। করদাতার ফাইলে হঠাৎ এত গাড়ি দেখালে ভয় পাওয়ারই কথা। কোনো করদাতা অভিযোগ করলে কর অফিস খতিয়ে দেখবে।