ওয়াশিংটনের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রচলিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চর্চা ও দ্বিপক্ষীয় সুবিধার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে ঢাকা। চুক্তির খসড়ায় ইতোমধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছালেও এখনও মতপার্থক্য রয়েছে। দেশের স্বার্থ রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে মতপার্থক্য কাটিয়ে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করতে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ।এর অংশ হিসেবে আলোচনায় অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা ছেড়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। চুক্তি হলে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপ করা ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার বা কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করছে সরকার।বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করার আগ্রহের কথা জানিয়ে একটি খসড়া পাঠায় ট্রাম্প প্রশাসন। তবে এতে এমন কিছু শর্ত রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ। তাই খসড়া সংশোধন করে ইতোমধ্যে তিন দফা মতামত পাঠিয়েছে ঢাকা। এ মতামতের ওপর গত ২৬ জুন ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে শর্তের বিষয়ে কিছু ক্ষেত্রে নমনীয় হলেও উভয়পক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।
খসড়ায় আবার সংশোধন এনে গত মঙ্গলবার নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশোধিত এ খসড়ার বিষয়ে দরকষাকষি করতে আজ আবারও ইউএসটিআরের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন খলিলুর রহমান। সভায় বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান অনলাইনে যুক্ত হবেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের উপস্থিতিতে ইউএসটিআরের সঙ্গে আগামী ৮ জুলাই আরও একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে অংশ নিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন।এ বিষয়ে গতকাল বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, শুল্ক চুক্তির খসড়ার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব সংশোধনী আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তার ছোট কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সম্মত হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা হয় না। এসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ একটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করার সময় অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়েও ভাবতে হয়। তবে চুক্তির ক্ষেত্রে বাধার বিষয়ে তিনি বিস্তারিত বলতে রাজি হননি।
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক স্থগিতের মেয়াদ ৮ জুলাই শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে চুক্তি করা সম্ভব না হলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে এমন প্রশ্নে বাণিজ্য সচিব বলেন, কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এখনও চুক্তি হয়নি। বাংলাদেশ দরকষাকষির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তিন দফা খসড়া বিনিময় হয়েছে। খসড়ার ওপর ইতোমধ্যে তিনটি বৈঠক হয়েছে। আরও দুটি হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া গত ২ এপ্রিলের পর এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২৮ দফা বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে। অন্য কোনো দেশ এত যোগাযোগ করেছে বলে তাঁর জানা নেই।বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত চুক্তিতে এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে, যা অন্যান্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে এমন শর্ত রয়েছে। ঢাকা ওয়াশিংটনকে জানিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট দেশের নিজস্ব আইন বাংলাদেশের পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শর্তারোপ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য আমদানিতে ছাড় দেবে, একই পণ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশকে ছাড় দেওয়া যাবে না। তবে এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মোস্ট-ফেভার্ড ন্যাশন (এমএফএন) নীতির বিরোধী হওয়ায় মানতে নারাজ বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এসব কঠিন শর্তের কারণেই এখন পর্যন্ত কোনো দেশই চুক্তি করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ইন্দোনেশিয়া চুক্তির বিষয়ে এগিয়ে থাকলেও কঠিন শর্তের কারণে দুই সপ্তাহ আগে তারা জানিয়ে দিয়েছে, এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা কোনো চুক্তি করবে না।গত ২ এপ্রিল বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাংলাদেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক ঘোষণা করা হয় ৩৭ শতাংশ। তবে ৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন প্রেসিডেন্ট। এর মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৮ জুলাই। যদিও সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক কার্যকর করা হয়েছে।