কড়া নাড়ছে নতুন বাজেট। প্রায় সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত। আরেকটি অর্থবছরের বড় তহবিল সংগ্রহের গুরুদায়িত্ব নিতে হবে রাজস্বকর্মীদের। অথচ বাজেট ঘিরে তাঁদের মধ্যে উচ্ছ্বাস-উদ্যমের বদলে এখন ক্ষোভ আর হতাশা। পুরো রাজস্ব খাত এখন নির্বিকার, ভূমিকাহীন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দেশজুড়ে প্রতিটি অফিস স্থবির। থমকে রয়েছে সব কার্যক্রম। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি আদায়ে একাট্টা হয়ে মাঠে। সেবা পাচ্ছেন না করদাতা, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। জমা হচ্ছে না রাজস্ব। বন্দরে কাজের ধীরগতি। দৈনন্দিন কাজে কারো মনোযোগ নেই।দেশের অর্থনীতির রক্তপ্রবাহ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রাজস্ব খাত বলতে গেলে প্রায় অচল। এর মধ্যে রাজস্বকর্মীদের নতুন কর্মসূচি এনবিআর বিভক্তির অধ্যাদেশ বাতিল আর সংস্থার চেয়ারম্যানের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অসহযোগ আন্দোলন।কয়েক দিন ধরেই এনবিআর বিভক্তি নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন সংস্থার কর্মীরা। আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস খাতের মাঠকর্মী থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন। দেশের অর্থনীতির প্রাণ এই রাজস্ব খাতের বিভক্তি নিয়ে রাতের অন্ধকারে অধ্যাদেশ জারি করার বিপক্ষে তাঁদের অবস্থান।
এই নিয়ে গত মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক হলেও তাতে কোনো সন্তোষজনক সমাধান না হওয়ায় নতুন করে আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংস্থার কর্মীরা। তাঁদের ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন করে রাজস্ব খাত বলতে গেলে প্রায় অচল করে দেওয়া হয়েছে। রাজস্ব আদায় প্রায় বন্ধ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। কারণ প্রতিদিন অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আছে। এটি সময়মতো আদায় করা সম্ভব না হলে চলতি বাজেট বাস্তবায়নের জন্য কাঙ্ক্ষিত তহবিল পাবে না সরকার। ফলে সরকারের দৈনন্দিন রাষ্ট্রীয় খরচ মেটানো বা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি দাতা সংস্থা বা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে হাত পাততে হবে। আর ব্যাংকব্যবস্থা থেকেও ধার করতে হবে।বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, এনবিআরের আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের দুই ধরনের কাজে অপরিহার্য। এক. রাজস্ব আহরণ; যেটার মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। দুই. কাস্টমস বিভাগের দৈনন্দিন ভিত্তিতে বহিঃবাণিজ্য। এই বিভাগ আমদানি ও রপ্তানির সামগ্রিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। এই দুই ক্যাডারের কাজ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন, রাজস্ব আহরণ ও বিনিয়োগের জন্য অপরিহার্য।
এনবিআরে কর্মরত আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কাজের গুরুত্ব তুলে ধরে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের এই নির্বাহী বলেন, যেকোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটলে রাষ্ট্র, অর্থনীতি, জনগণের পাশাপাশি সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে দুই পক্ষকেই সমাধানের দৃষ্টিকোণ থেকে একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছতে হবে। সমাধান মূলত সদিচ্ছার ব্যাপার। সদিচ্ছা থাকলে সমাধান সম্ভব।এই আন্দোলনের ফলে বিনিয়োগকারীরাও দ্বিধায় পড়বেন বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, রাজস্ব কার্যক্রমের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের একটা যোগসূত্র আছে। বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্য। আমদানি ও রপ্তানি। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হবে। রপ্তানি চালু রেখে আমদানি বন্ধ রাখলে ভবিষ্যৎ রপ্তানি সমস্যায় পড়বে। রপ্তানি পণ্যের একটা অংশ আমদানি করে সেই পণ্য উৎপাদন করা হয়। আমার কাঁচামাল তো থাকতে হবে। সামনের বিনিয়োগ পরিস্থিতির জন্যও এটা চ্যালেঞ্জিং হবে। এ ধরনের পরিস্থিতি সমাধানের আগে বিনিয়োগকারীরাও একটু দ্বিধার মধ্যে পড়বেন। সার্বিকভাবে ডিজিটাইজেশনসহ এনবিআরের বাকি যে সংস্কারগুলো প্রয়োজন ছিল তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল।