দশ পণ্যে রাজস্ব আহরণে ধসআমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের শুল্ককর যৌক্তিক হতে হবেমেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চায় আইপিডিস্বর্ণালংকারে ভ্যাট কমানোর দাবি বাজুসেরসিগারেটে কর বাড়ানোর আহ্বান এমপিদের
No icon

ঘাটতি মেটাতে নতুন ভ্যাট আইনেই সমাধান দেখছে এনবিআর

গত অর্থবছর রাজস্ব আহরণে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতিতে ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই এ ঘাটতি ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় ও রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ায় অটোমেশন আটকে থাকায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের মধ্যেই তাই সমাধান দেখছেন তারা। এ অবস্থায় তিন স্তরের ভ্যাটহার রেখে চলতি বছরের জুলাই থেকে যেকোনো উপায়ে আইনটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকেই নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল এনবিআর। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে তা হয়নি। রাজস্বের সবচেয়ে বড় খাত ভ্যাটে নতুন আইন কার্যকর না হওয়ায় আটকে আছে এনবিআরের পুরো অনলাইন প্রক্রিয়াও।

এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, ভ্যাটে অনলাইন ব্যবস্থা চালু হলে ভ্যাটের পাশাপাশি আয়করেও ফাঁকি কমে আসবে। পণ্যের বিক্রি তথ্যের ওপর অনলাইনে ভ্যাট আদায় করলে আয়ের হিসাব অটোমেশনে চলে আসবে। এটি হলেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যেই অনলাইনভিত্তিক ভ্যাট ব্যবস্থা ও নতুন আইন বাস্তবায়নে কাজ করছে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প ও একটি স্বতন্ত্র কমিটি। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন ভ্যাট আইনের সংশোধনী চূড়ান্ত হবে। ভ্যাটের তিনটি স্তরসহ কিছু সংশোধন এনে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এনবিআরের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি। এরপর তা অর্থমন্ত্রীর মতামতের জন্য পাঠানো হবে।

অন্যদিকে ৫ কোটি টাকার বেশি টার্নওভার দেখানো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব সফটওয়্যার বসানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প। বার্ষিক ৮০ লাখ টাকার বেশি টার্নওভার দেখানো প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসাতে ফেব্রুয়ারিতে টেন্ডারও আহ্বান করা হয়েছে। ফলে সব প্রস্তুতি শেষ করে জুলাইয়ে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হবে।

এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত আইনটি সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটি চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে এনবিআরের চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়ার কাছে প্রতিবেদন আকারে জমা দেবে। এরপর অর্থমন্ত্রীর মতামত শেষে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তা চূড়ান্ত করা হবে। নতুন আইনে ভ্যাটের তিনটি স্তর রাখাসহ ভ্যাট আহরণের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি অটোমেশনের মধ্যে নিয়ে আসার বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে প্রতিবেদনে।

এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট নীতি) মো. রেজাউল হাসান বলেন, নতুন আইন বাস্তবায়নে আমাদের প্রস্তুতি অনেকটাই শেষ পর্যায়ে। ২০১৯ সালের জুলাই থেকেই তা কার্যকর হবে। ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে আইনটির ওপর যেসব আপত্তি এসেছিল তা সমাধান করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়গুলোও সংশোধন করতে এনবিআর একটি কমিটি গঠন করেছে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি। প্রতিবেদনের আলোকেই চূড়ান্ত সংশোধন শেষে অর্থমন্ত্রীর কাছে তা মতামতের জন্য পাঠানো হবে।

নতুন আইনে ভ্যাটের হার নির্ধারণ প্রসঙ্গে এনবিআরের এ সদস্য বলেন, ২০১৭ সালে আইনটি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে ভ্যাটের একক হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণই দায়ী বলে মনে করছে এনবিআর। ফলে এবার একাধিক হার রাখার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তবে কয়টি স্তর হবে তা এখনই চূড়ান্ত নয়। এনবিআরের পক্ষ থেকে ভ্যাটের কয়েকটি হার রেখে প্রস্তাব তৈরি করা হবে। কোন হার বাস্তবায়ন করলে রাজস্বে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা প্রতিবেদনে থাকবে। সরকার এনবিআরের প্রস্তাব থেকে যেটি যথোপযুক্ত মনে করবে সেটি চূড়ান্ত হবে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসায়ীদের মতামত নিয়ে মূল্য সংযোজন কর আইন-২০১২ বাস্তবায়নে এরই মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এনবিআর। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন ভ্যাট আইনের স্তর ও ট্যারিফ হারসহ বিস্তারিত প্রস্তাব তৈরি হবে। প্রস্তাবে ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশের পাশাপশি ১০ ও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে আরো দুটি স্তর রাখা হচ্ছে। বর্তমানে ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রায় ১ হাজার ১৫০টি পণ্য থেকে কিছু পণ্যকে ভ্যাটের সর্বশেষ স্তরের আওতায় আনার সুপারিশ থাকবে। পাশাপাশি ট্যারিফভিত্তিক ভ্যাট আদায় করা ইট, সিমেন্ট, রডসহ কিছু পণ্যকেও একই স্তরের অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ থাকবে। এর বাইরে ভ্যাট আইনে রাজস্ব ফাঁকিতে জরিমানার হার বাড়ানো, সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনা এবং ভ্যাট নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ ও সহজীকরণের বিধান যুক্ত করার সুপারিশ থাকছে প্রস্তাবে।

জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হবে। আইনে কিছুটা সংস্কার আনা হচ্ছে। সব পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করার বিষয়টি একটু অসুবিধা হয়ে যায়। আমরা কয়েকটি স্তর করার পরিকল্পনা নিয়েছি। খুব সম্ভবত তিনটি স্তর করা হবে। এতে মানুষের ওপর ভ্যাটের চাপ কমবে। অন্যদিকে পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় রাজস্ব আহরণ অনেক বাড়বে। অনলাইন সিস্টেম চালু হলে উভয় দিকে দুর্নীতি কমবে।

উল্লেখ্য, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন ছাড়াই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ঘাটতি রয়েছে এনবিআরের। এর মধ্যে ভ্যাট খাতেই ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঘাটতিতে রয়েছে সংস্থাটি। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ভ্যাটে ৫০ হাজার ২৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব এসেছে ৩৭ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে এনবিআরের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। যদিও অর্থবছরে ভ্যাটে প্রায় ৩৩ শতাংশ ও মোট রাজস্বে ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এনবিআরের।

কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি ও রাজস্ব লক্ষ্যপূরণে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন দরকার বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরাও। তবে ভ্যাটের হার একক না রেখে সবার জন্য সহনীয় ভ্যাট আইন চান তারা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীরা হয়রানিমুক্তভাবে ট্যাক্স-ভ্যাট দিতে চান। আস্থার মাধ্যমে উভয় পক্ষ দেশের উন্নয়নে কাজ করবে। ২৫ শতাংশ মানুষ ৮৫ শতাংশ রাজস্বের জোগান দিয়ে থাকে। ভ্যাট ব্যবস্থা অনলাইন করে উৎপাদন পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে রাজস্ব আদায় বাড়বে। এটি সম্ভব হলে ভ্যাট কর্মকর্তাদেরও টেনেহিঁচড়ে ভ্যাট আদায় করার প্রয়োজন হবে না। তবে আইনটি ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে সহজভাবে তৈরি করতে হবে।